খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী, ফরিদুদ্দিন গঞ্জে শকর, নিযামুদ্দীন আউলিয়া প্রমুখ উলামা ও মাশায়িখ রাহিমাহুমুল্লাহ আল্লাহর দ্বীন পালন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর দ্বীন পালন ও প্রতিষ্ঠায় কোনো লোভ বা ভয় তাঁদেরকে সামান্যতম দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারেনি। ইলম, আমল, জিহাদ, দাওয়াত, তাহাজ্জুদ, যিকর, রোযা, নামায ইত্যাদি সকল কর্ম তাঁরা সুন্নাত পদ্ধতিতে পালন করেছেন এবং করতে শিখিয়েছেন। তবে তাঁরা বাজনা ছাড়া কাওয়ালির মজলিস করতেন, কাওয়ালী শুনে তাঁরা অনেক সময় বেহুঁশ হয়ে যেতেন, নাচানাচি করতেন বা কাপড় চোপড় ছিঁড়ে ফেলতেন। আমরা এখন জানতে পেরেছি যে, এগুলো কখনোই রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ও তাঁর সাহাবাগণের রীতি ছিল না। এখন আমরা করণীয় কী? রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ও তাঁর সাহাবীগণ আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য এসব করেননি জেনেও বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের দোহাই দিয়ে তাঁদের এ ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকব? তাঁদের মতো রোযা, তাহাজ্জুদ, যিকর, দাওয়াত, জিহাদ ইত্যাদি না করতে পারলেও অন্তত তাঁদের মতো কাওয়ালি, নর্তন কুর্দন ইত্যাদি করব ? নাকি তাঁদের শিক্ষা ও সামগ্রিক কর্ম অনুসরণে নিজেদেরকে আল্লাহর দ্বীনের পরিপূর্ণ পালন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য বিলিয়ে দেব?
আল্লাহর দ্বীনের পরিপূর্ণ পালন ও প্রতিষ্ঠার আরেক সিপাহসালার মুজাদ্দিদে আলফে সানী। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সুন্নাতের প্রতিষ্ঠা ও বিদ‘আতের বিনাশের জন্য। তাঁর যুগে মুসলমানেরা পীর, বুজুর্গ ও রাজা-বাদশাহদেরকে সাজদা করত। অনেকে তাঁদের সামনে গড় হয়ে বা শুয়ে পড়ে মাটিতে চুমু খেত, যা জমিনবুছি বলে পরিচিত। মুজাদ্দিদে আলফে সানী তাঁর সমাজে প্রচলিত মানুষকে সাজদা করার রীতির প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন। কিন্তু তিনি যমিনবুছির বিরোধিতা করেননি। বরং জায়েয বলে মেনে নিয়েছেন। অথচ যমিনবুছিও খেলাফে সুন্নাত কর্ম। এখন আমরা কী করব ? তিনি যমিনবুছির বিরোধিতা করেননি বলে আমরা এর প্রচলন করব ? না-কি আমরা মনে করব যে, বৃহত্তর কল্যাণের জন্য তিনি ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে বিতর্ক এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি বড় অন্যায় দূর করে গিয়েছেন, এখন আমাদের দায়িত্ব হলো তাঁদের ফেলে রেখে যাওয়া ছোটখাট ভুলগুলো দূর করা?
এ ধরনের অগণিত উদাহরণ দেওয়া যায়। এসব কিছু দেখে এবং রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) এর সুন্নাতকে জীবিত করার জন্য বুযুর্গগণের জোর তাগিদে প্রভাবিত হয়ে আমি সামান্য কিছু লেখার চেষ্টা করেছি। কারো সমালোচনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। সকল মুসলিম আলিম আমাদের মাথার মণি। আমরা তাঁদের পায়ের ধূলিতুল্যও নই। তবে আমার মনে হয় রাসূলে আকরাম (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে হৃদয়ের সর্বোচ্চ মণিকোঠায় বসালে আর কারো সমালোচনা হয় না, কোনো বুজুর্গই এতে বিন্দুমাত্র নাখোশ হবেন না।
আমার মনে হয়, আমাদের হৃদয়ের অবস্থা এমন হওয়া উচিত যে, আমাদের হৃদয় জুড়ে আছেন শুধু রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)। সবচেয়ে বড় আদর্শ তিনিই। সবচেয়ে বড় সহচর ও অনুসারী তাঁর সাহাবীগণ। তাঁদের কথা, তাঁদের কাজ, তাঁদের আচার, তাদের জীবন আমাদের এত ভালো লাগে যে, আর কাউকেই হৃদয়ের সেই স্থানে স্থান দিতে পারি না। যখনই কোনো বরেণ্য আলিম, সূফী, ইমাম বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের থেকে কোনো নেক কাজের কথা আমরা জানতে পাই, তখনই মনের অজান্তেই আমাদের মনে প্রশ্ন এসে পড়ে-রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ও তাঁর সাহাবীগণ কি এ কাজটি করেছেন? করলে কীভাবে করেছেন? আমরা কি অবিকল তাঁদের মতো করে বা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব না ? যখনই কোনো বরেণ্য আলিম থেকে কোনো মতামত, কোনো ব্যাখ্যা বা কোনো চিন্তাধারা জানতে পারি, তখনই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: রাসূলুল্লাহ (صَلَّى ٱللَّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ও তাঁর সাহাবীগণ এ বিষয়ে কী বলেছেন, কী মতামত পোষণ করেছেন বা কী ব্যাখ্যা দান করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যাই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? আমাদের হৃদয়ের অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে কি তা নিন্দনীয় হবে?
এহইয়াউস সুনান, ১১-১৩পৃ.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ।
Comments
Post a Comment